- রাহু নামটি শুনলেই মানুষের মনে ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
- রাহুর দশা বা অন্তর্দশা এলে জীবনে নানা রকম সমস্যার আশঙ্কা করা হয়, যেমন—আর্থিক ক্ষতি, পারিবারিক কলহ, বা স্বাস্থ্যহানি।
- যদিও রাহু সবসময় নেতিবাচক ফল দেয় না; কিছু ক্ষেত্রে এটি সাংসারিক লাভ, সম্মান ও সমৃদ্ধিও এনে দিতে পারে।
- ফলাফল নির্ভর করে ব্যক্তির কুণ্ডলীতে রাহুর অবস্থান, দৃষ্টি এবং অন্যান্য গ্রহের প্রভাবের উপর।
- জ্যোতিষে রাহুর অবস্থান ও প্রভাব
- বৈদিক জ্যোতিষে রাহু ও কেতুকে ছায়া গ্রহ হিসেবে গণ্য করা হয়, সৌরজগতে যাদের কোনো ভৌত অস্তিত্ব নেই।
- পৌরাণিক কাহিনী:
- দেবতাদের মধ্যে অমৃত বণ্টনের সময় স্বরভানু নামক এক রাক্ষস ছদ্মবেশে অমৃত পান করে।
- চন্দ্র ও সূর্য এই ঘটনা ভগবান বিষ্ণুকে জানালে, বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে স্বরভানুর শিরশ্ছেদ করেন।
- অমৃত পানের কারণে স্বরভানু অমরত্ব লাভ করে, এবং তার শরীরের দুই অংশ রাহু (মাথা থেকে গলা) ও কেতু (গলা থেকে পা) নামে পরিচিত হয়।
- সূর্য ও চন্দ্রের প্রতি প্রতিশোধ নিতেই রাহু-কেতু সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ হয়।
- গ্রহণের ব্যাখ্যা:
- আধুনিক বিজ্ঞান পৌরাণিক কাহিনীকে সরাসরি গ্রহণ না করলেও, গ্রহণকালে গ্রহের অবস্থান এই ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- সূর্যগ্রহণে সূর্য রাহু বা কেতুর কাছাকাছি ডিগ্রিতে থাকে এবং চন্দ্রগ্রহণে চন্দ্র রাহু বা কেতুর কাছাকাছি অবস্থান করে।
- জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, গ্রহণের সময় নেতিবাচক শক্তি বৃদ্ধি পায়, যা রাহুর প্রভাব হিসেবে বিবেচিত।
- কুণ্ডলীতে রাহুর স্থান ও এর প্রভাব
- কুণ্ডলী চক্রে রাহু-কেতুর নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট ঘর বা ভাব নেই।
- রাহু কুম্ভ রাশির সহ-অধিপতি এবং কেতু বৃশ্চিক রাশির সহ-অধিপতি হিসেবে বিবেচিত।
- উচ্চস্থ ঘর নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে; কেউ বৃষ রাশিকে রাহুর উচ্চস্থ ঘর মনে করেন, আবার কেউ মিথুন বা ধনু রাশিকে কেতুর উচ্চস্থ ঘর হিসেবে মানেন।
- জ্যোতিষে রাহুকে সাংসারিক সুখ ও ভোগের কারক গ্রহ হিসেবে দেখা হয়।
- রাহুর দশায় মানুষ ধন, খাদ্য, বিনোদন এবং সাংসারিক সুখ-ভোগের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়।
- এই আকর্ষণ অনেক সময় মানুষকে আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং ডিসিপ্লিন, ন্যায়-নীতি ও ধর্ম থেকে বিচ্যুত করে।
- এর ফলে শারীরিক সমস্যা (যেমন রোগ), কর্মে ব্যাঘাত, মানসিক অবনতি এবং পারিবারিক ঝামেলা দেখা দিতে পারে।
- অতিরিক্ত লোভ এবং প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা অনেক সময় অনিষ্ট ও অপযশের কারণ হয়।
- প্রকৃত সুখের মূল চাবিকাঠি হলো জীবনযাত্রায় ডিসিপ্লিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ন্যায়-নীতি এবং ধর্ম মেনে চলা।
- এসব মেনে চললে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, কর্মে উন্নতি আসে এবং জীবন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
- সুতরাং, রাহুর নেতিবাচক প্রভাবের পেছনে মানুষের নিজস্ব কর্ম ও মানসিকতাও অনেকাংশে দায়ী।
রাহুর অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির উপায়
রাহুর অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির উপায়
- রাহুর দশা বা অন্তর্দশায় দৈনন্দিন নিয়ম ভাঙার কারণে জীবনে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। রাহুর অশুভ প্রভাব থেকে বাঁচতে আধ্যাত্মিকতা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি।
- আধ্যাত্মিকতা ও কেতুর গুণাবলী ধারণ:
- রাহুর অশুভ প্রভাব কাটাতে কেতুর বৈশিষ্ট্য (আধ্যাত্মিকতা) গ্রহণ করা উচিত।
- কেতু ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক।
- জীবনে শৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ন্যায়-নীতি এবং ধর্মকে প্রাধান্য দিলে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায়।
- আধ্যাত্মিক জীবনযাপন রাহুর নেতিবাচকতা কাটিয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনে।
- কেতুর সাহায্যে রাহুর সৃষ্ট মায়াজাল (লোভ ও অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা) থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
- রাহুর অশুভ প্রভাব কাটাতে পূজা ও মন্ত্র সাধনা:
- রাহুর অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে এবং এর শুভ ফল লাভ করতে বিশেষ কিছু পূজা ও মন্ত্র সাধনা অত্যন্ত কার্যকরী:
- নিয়মিত ধ্যান ও পূজা: প্রতিদিনের রুটিনে ধ্যান এবং পূজা অন্তর্ভুক্ত করুন। এটি মনকে শান্ত রাখতে ও ইতিবাচক শক্তি আকর্ষণ করতে সাহায্য করে।
- মন্ত্র জপ:
- রাহুর কুফল কাটাতে গায়ত্রী মন্ত্র (ॐ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ) জপ করলে মানসিক শান্তি আসে এবং রাহুর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস পায়।
- এছাড়াও, রাহুর নিজস্ব বীজ মন্ত্র জপ করা যেতে পারে: "ওঁ ভ্রাং ভ্রীং ভ্রৌং সঃ রাহবে নমঃ"। এই মন্ত্রটি প্রতিদিন ১০৮ বার জপ করলে রাহুর অশুভ প্রভাব কমে আসে এবং শুভ ফল প্রাপ্তি হয়।
- ভগবান শিবের পূজা:
- ভগবান শিবকে রাহুর অধিদেবতা হিসেবে মানা হয়। তাই শিবের পূজা করলে রাহুর খারাপ প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং শুভ ফল লাভ হয়।
- নিয়মিত শিবলিঙ্গে জল ও বেলপাতা অর্পণ করা, শিব চালিসা পাঠ করা এবং "ওঁ নমঃ শিবায়" মন্ত্র জপ করা রাহুকে শান্ত করতে সাহায্য করে।
- শিবের কৃপায় রাহু তার নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
- জীবনশৈলীতে পরিবর্তন:
- পূজাপাঠ ও মন্ত্র জপের পাশাপাশি কিছু জীবনশৈলী পরিবর্তনও রাহুর শুভ ফল পেতে সাহায্য করে:
- সাত্ত্বিক আহার: আমিষ খাদ্য কমিয়ে নিরামিষ গ্রহণ করুন। এটি শরীর ও মনকে শুদ্ধ করে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির সহায়ক হয়।
- নেশা ত্যাগ: মদ, ধূমপান সহ সকল প্রকার নেশা সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করুন। নেশা মানসিক শান্তি নষ্ট করে এবং রাহুর অশুভ প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে।
- এই সম্মিলিত পদ্ধতিগুলো নিয়মিত অনুসরণ করলে রাহুর কারণে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি, পারিবারিক কলহ বা স্বাস্থ্য সমস্যার মতো নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- জীবনে আর্থিক উন্নতি ও পারিবারিক সুখের মতো শুভ ফল লাভ হয়।
- উপসংহার
- রাহুর দশায় কেতুর গুণাবলী (আধ্যাত্মিকতা) অবলম্বন করা উচিত।
- আধ্যাত্মিক জীবনযাপন রাহুর অনিষ্ট প্রতিরোধ করে এবং জীবনে স্থিতিশীলতা আনে।
- ধর্ম, নৈতিকতা এবং পরিশ্রম মেনে চললে জীবনে প্রকৃত সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ হয়।
- রাহু থেকে ভয়ের পরিবর্তে বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে এর প্রভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আপনার যদি জ্যোতিষশাস্ত্র বা রাহু-কেতু সম্পর্কিত আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।