সপ্তম ঘরে মঙ্গল: শুভাশুভ ফল ও প্রতিকার।

Astrobless
By -

জন্ম কুণ্ডলীর সপ্তম ঘর (বিবাহ বা দাম্পত্য স্থান) ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। 

এই স্থানটি কেবল জীবনসঙ্গী বা পত্নী/পতির বিচার করে না। বরং এটি আমাদের জীবনের সমস্ত পার্টনারশিপ, ব্যবসা-বাণিজ্য (Business Partnership) এবং সাধারণ জনগণের সাথে আমাদের দৈনন্দিন লেনদেন (Transaction) ও ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্র। এই ঘরকে "কাম স্থান" বা 'যৌথ উদ্যোগের স্থান' বলা হয়।

​সপ্তম ঘরের কারকতা ও গ্রহ বিচার

​সপ্তম ঘর থেকে প্রাপ্ত শুভাশুভ ফল নির্ভর করে সেই ঘরের অধিপতি গ্রহের অবস্থা, ঘরের মধ্যে অবস্থানকারী গ্রহ এবং কারক গ্রহগুলির বলাবলের উপর।

​বিবাহের কারক গ্রহের ভূমিকা

  • গুরু (বৃহস্পতি) ও শুক্র: এই দুটি গ্রহকে বিবাহের প্রধান কারক গ্রহ হিসেবে গণ্য করা হয়।
  • পুরুষদের ক্ষেত্রে: শুক্র হলেন স্ত্রীর কারক গ্রহ। শুক্রের শুভ অবস্থান দাম্পত্য জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনে।
  • স্ত্রীদের ক্ষেত্রে: গুরু (বৃহস্পতি) হলেন স্বামীর কারক গ্রহ। শক্তিশালী ও শুভ গুরু স্বামীর গুণাবলী ও সৌভাগ্য নির্দেশ করে।
  • মঙ্গল: কিছু জ্যোতিষী মঙ্গলকেও স্ত্রীদের ক্ষেত্রে স্বামীর কারক হিসাবে বিবেচনা করেন, যা মূলত স্বামীর তেজ, সাহস এবং জীবনের প্রতি তাঁর সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়।

​ব্যবসার কারক গ্রহ

  • বুধ (Mercury): সপ্তম ঘর থেকে ব্যবসার বিচার করার সময় বুধকে ব্যবসার কারক হিসাবে মানা হয়। বুধের শক্তি ব্যবসায়িক বুদ্ধি, যোগাযোগ ক্ষমতা এবং লাভ-ক্ষতির হিসেব নিকেশের দক্ষতা প্রদান করে।

​সপ্তম ঘর, ঘরের অধিপতি এবং কারক গুরু, শুক্র, মঙ্গল ও বুধ যদি শুভ অবস্থানে থাকে এবং শক্তিশালী হয়, তবে জাতক-জাতিকার জীবনসঙ্গী উত্তম হন, দাম্পত্য জীবন সুখের হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সফলতা আসে। এর বিপরীত হলে, অর্থাৎ অশুভ অবস্থানে, দুর্বল বা পাপ গ্রহের প্রভাবে থাকলে উক্ত বিষয়গুলিতে সমস্যা বা বাধা সৃষ্টি হয়।

Mars in the Seventh House: Auspicious and Inauspicious Results with Remedies.

​মঙ্গল গ্রহ: সেনাপতি ও তার বৈশিষ্ট্য

​মঙ্গল সৌরজগতের চতুর্থ এবং একটি অগ্নিতত্ত্ব গ্রহ (Fiery Planet)। এটি তেজ, শক্তি এবং সাহসের প্রতীক। পৌরাণিক শাস্ত্র অনুযায়ী মঙ্গলকে গ্রহদের সেনাপতি বলা হয়, যা তার নেতৃত্ব, পরাক্রম এবং সংকল্পের গুণাবলীকে তুলে ধরে।

  • মঙ্গল থেকে বিচার: সাহস, পরাক্রম, সংকল্প, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষমতা।

  • বলবান মঙ্গলের ফল: জন্ম কুণ্ডলীতে মঙ্গল বলবান হলে ব্যক্তি সাহসী, উদ্যমী, পরাক্রমী এবং একজন দক্ষ নেতা হন। এরা লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকেন।
  • দুর্বল মঙ্গলের ফল: জাতক-জাতিকা শারীরিকভাবে দুর্বল হন এবং তাদের মধ্যে সাহস-পরাক্রমের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে তারা যেকোনো নতুন কাজ শুরু করতে বা চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান।

​কালপুরুষ কুণ্ডলীতে মঙ্গলের আধিপত্য

​কালপুরুষের কুণ্ডলীতে মঙ্গল দুটি রাশির অধিপতি:

মেষ রাশি (প্রথম ঘর): শরীর, ব্যক্তিত্ব, মন-মানসিকতা ও মান-সম্মান।

বৃশ্চিক রাশি (অষ্টম ঘর): দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, গুপ্তবিদ্যা, গুপ্তধন এবং গুপ্ত বিষয়ের বিচার করা হয়। মঙ্গল এই দুই ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে জীবন শক্তি এবং গভীর পরিবর্তনের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

​সপ্তম ঘরে মঙ্গলের অবস্থান এবং ফলাফল বিশ্লেষণ

​সপ্তম ঘরে মঙ্গলের অবস্থান বিবাহের ঘর এবং পার্টনারশিপের ক্ষেত্রকে সরাসরি প্রভাবিত করে।

​শুভফল বা অনুকূল প্রভাব

  • অবস্থান: সপ্তম ঘরে মঙ্গল যদি স্বরাশি (মেষ বা বৃশ্চিক), মিত্ররাশি বা উচ্চরাশিতে (মকর) অবস্থান করে এবং শুভ গ্রহের প্রভাবযুক্ত হয়।
  • ফলাফল: জাতক-জাতিকা অত্যন্ত সাহসী, পরাক্রমী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন। বিবাহের মাধ্যমে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী জীবনসঙ্গী লাভ করেন।
  • ব্যবসা-বাণিজ্য: এরা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিপুণ হন এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা থাকায় বড় ধরনের সাফল্যে অর্জন করতে পারেন। এঁরা সক্রিয় এবং উদ্যোগী পার্টনার হিসেবে পরিচিত হন।

​অশুভফল বা প্রতিকূল প্রভাব

  • অবস্থান: সপ্তম ঘরে মঙ্গল শত্রুরাশি বা নীচ রাশিতে (কর্কট) অবস্থান করলে এবং অশুভ গ্রহের দ্বারা প্রভাবযুক্ত হলে।
  • দাম্পত্য জীবন: জাতক-জাতিকা রাগী, ঝগড়াটে এবং বদমেজাজি হতে পারেন। মঙ্গলের এই উগ্র স্বভাবের কারণে দাম্পত্য জীবনে ঘন ঘন মনোমালিন্য, মতভেদ এবং বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটতে পারে। একেই জ্যোতিষশাস্ত্রে "মাঙ্গলিক দোষ" এর একটি রূপ হিসাবে দেখা হয়।
  • কর্মক্ষেত্র: এদের মধ্যে অবাঞ্ছিত ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা ব্যবসা-বাণিজ্য সহ অন্যান্য দৈনন্দিন কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের সমস্যার সৃষ্টি করে।
  • প্রতিকার: তবে মনে রাখতে হবে, শুভ গ্রহের প্রভাবে এই অশুভ প্রভাব বা রাগের প্রবণতা হ্রাস পায় এবং জাতক-জাতিকা নিজেদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হন।

​সপ্তম ঘরে মঙ্গলের শুভফল লাভের বিস্তারিত উপায়

​জন্ম কুণ্ডলীতে মঙ্গল শুভ বা অশুভ যেভাবেই অবস্থান করুক না কেন, মঙ্গলের মূল গুণাবলীকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই এই গ্রহের শুভত্বকে বাড়ানো সম্ভব।

​1.শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে মঙ্গলের আদর্শ অনুসরণ

​মঙ্গল গ্রহ শৃঙ্খলা (Discipline) ও নিয়মের কারক। সপ্তম ঘরে মঙ্গল থাকলে জীবনসঙ্গী, পার্টনার বা যেকোনো ব্যক্তির সাথে কাজকর্মে অবশ্যই এই গুণগুলি বজায় রাখতে হবে।

  • দৈনন্দিন কর্মে শৃঙ্খলা: কাজে শৃঙ্খলার অভাব বা অপরিচ্ছন্নতা কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কে ঝামেলা বা সংঘাত সৃষ্টি করে।
  • রাগের নিয়ন্ত্রণ: এই ঝামেলাগুলি থেকেই রাগের বহিঃপ্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা অনিষ্টদায়ক ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই জীবনযাত্রায়, বিশেষ করে যৌথ কাজে, সময়ানুবর্তিতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা মঙ্গলের শুভফল লাভের প্রধান চাবিকাঠি।

​2. খাবার-দাবারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা

​মঙ্গল শরীরের রক্ত কণিকার (Blood Corpuscles) কারক। সপ্তম ঘরে অবস্থান করে মঙ্গল তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি লগ্নে অর্থাৎ শরীর, ব্যক্তিত্ব ও মন-মানসিকতার উপর ফেলে।

  • উত্তেজক খাবার পরিহার: কুণ্ডলীতে মঙ্গল অধিক অশুভ প্রভাবযুক্ত হলে, যে সব খাবার ব্লাড সার্কুলেশন অতিরিক্ত বাড়িয়ে তোলে এবং মনকে উত্তেজিত করে, সেগুলি ত্যাগ করা বা কম খাওয়াই ভালো। এর মধ্যে আমিষ জাতীয় এবং অতিরিক্ত মশলাযুক্ত উত্তেজক খাবার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরিমিত এবং সাত্ত্বিক খাবার মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।

​৩. পূজাপাঠ ও মন্ত্র সাধনা দ্বারা আত্মশুদ্ধি

​ধর্মীয় অভ্যাস এবং মন্ত্র সাধনা মঙ্গলের উগ্র শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত ও ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করতে সহায়ক।

  • মন্ত্র জপ: মঙ্গলের বীজমন্ত্র বা অন্যান্য মঙ্গল সংক্রান্ত মন্ত্রপাঠ (যেমন: ওম ক্রাং ক্রীং ক্রৌং সঃ ভৌমায় নমঃ) শুভফল প্রাপ্তিতে সহায়ক সিদ্ধ হয়।
  • আরাধনা: হনুমান চালিসা পাঠ সহ মা দুর্গা এবং বজরাংবলীর (হনুমান জি) আরাধনা মঙ্গল গ্রহের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমিত করতে পারে। হনুমানজি শৃঙ্খলা, ব্রহ্মচর্য ও শক্তির প্রতীক, যা মঙ্গলের অশুভ দিককে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়।
  • ব্রত পালন: মঙ্গলবার ব্রত পালন করাও শুভফল বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক।

​উপসংহার

​পরিশেষে বলা যায়, জন্ম কুণ্ডলীতে মঙ্গল গ্রহের অবস্থান যেমনই হোক না কেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন, মানসিক ও বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, এবং ধর্ম ও ন্যায়-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার মাধ্যমেই সপ্তম ঘরের শুভ ফল লাভ করা সম্ভব। 

এই নিয়মানুবর্তিতা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমরা মঙ্গলের তেজ এবং শক্তিকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে – বিশেষ করে দাম্পত্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্কে – ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে সফলতা অর্জন করতে পারি।

ডিসক্লেইমার: জ্যোতিষশাস্ত্র একটি প্রাচীন বিশ্বাস ও বিদ্যা এবং এর ফলফল ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও জীবনযাত্রার ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একজন অভিজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

​আপনার কি মঙ্গলের প্রতিকার বা অন্য কোনো গ্রহের প্রভাব সম্পর্কে জানার আগ্রহ আছে?

আরো জানুন